“প্রিয় অধ্যাপক,
আমি গত সপ্তাহে অন্য একটা আপনার উইমেন্স লিটারেচার কোর্সে ভর্তি হয়েছি। আপনাকে লিখছি একটা বিশেষ কারণে। কলেজের তালিকায় আমি ড্যাফনে ওয়াকর। নামটা আমার পছন্দ নয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক আলোচনার পরেও তারা আমার ইচ্ছা মেনে নেয়নি। কিন্তু আমি পুরুষমনস্ক। আমার বিশ্বাস আমি পুরুষ। আমাকে আপনি ড্যামিয়ান ডাকলে আমি খুশি হবো। দেখা হবে”।
টার্মের প্রথমে কলেজের চিঠিপত্র একটু নাড়াচাড়া করে নেওয়া। জরুরী গুলো বেছে নিয়ে প্রয়োজনীয় জবাব। কাটছাঁট চিঠিটা সকালবেলা মেল খুলতেই লাফিয়ে উঠলো চোখের সামনে। অন্য সব কাজ অকাজের চিঠি ফেলে রেখে উঠে পড়লো পরমা। এক কাপ কড়া কফি নিয়ে আবার চিঠিতে ফেরৎ। টুক করে মাঝখনে একবার কলেজ ওয়েবসাইটে গিয়ে ছাত্র তালিকা জরীপ: ড্যাফনে ওয়াকার ১৫৮৬০৩৮। খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখলো পরমা। নরম একটা মুখ। বড় বড় বাদামি চোখ চাপা ঠোঁট। খুব ছোট করে ছাঁটা চুল। চিঠির উত্তর টা মনে মনে ছ’কে নিয়ে কি-বোর্ডে আঙ্গুল :
“প্রিয় ড্যামিয়ান. তোমার চিঠি পেয়েছি। মঙ্গলবার দেখা হবে”।
আপাততঃ এই থাক।
নিজের মনে অল্প একটু হেসেও নিলো। ‘দেখা হবে’ কথটার মধ্যে কোথাও একটা যুদ্ধর গন্ধ আছে। “ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে…” এটাও একরকম যুদ্ধই। তবে পরমার এখনকার যুদ্ধটা কিসের সঙ্গে সেটাও একটু ভেবে নিতে হবে। মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় আছে। সারাজীবন অনেক যুদ্ধ করেছে পরমা : রুচির যুদ্ধ, বিশ্বাসের যুদ্ধ, প্রেম-অপ্রেমের যুদ্ধ। সন্ধি করেনি বা করেছে। হেরেও গেছে অনেক সময়। খানিকটা নিজের দুর্বলতায়, কখনো অন্য সব কারণে। কিছু কাটাছেঁড়ার দাগ রয়ে গেছে আজও। কোনওকালেই খুব একটা রং মাখর অভ্যেস নেই। দাগ গুলো বেশ পরিস্কার। কিন্তু এই যুদ্ধটা আলাদা। নিজের সঙ্গে। তারপর সম্মুখ সমর একটা একরত্তি মানবকের সঙ্গে। আবারও চোরা হাসিতে ঠোঁট কাঁপলো পরমার। প্রথম ধাপ উতরেছে, ‘একরত্তি মেয়ে’ ভেবে ফেলেছিলো আর একটু হলেই!
****
নদীর পাশ দিয়ে রাস্তাটাই বেশী পছন্দ পরমার। নদী যখন বরফে মোড়া থাকে তখনও । সাপের মত পার্কওয়ে ড্রাইভে একটা মুক্তির স্বাদ আছে। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে এলোমেলো চিন্তা করা যায়। গানও চ’লে হাল্কা করে। আজ একটু অন্যরকম। কলেজর কথা মনে পড়ে গেলো। কলেজ না, দেড়শো বছরের পুরোনো লাইব্রেরী ভর্তি বই, সবই অন্ততঃ চল্লিশ বছরর পুরোনো। কছু বই এমন ঝুরঝুরে, লাইব্রেরীর বাইরে নেওয়া যেতোনা। ওভিডর মেটামর্ফোসিসটা ছিল মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো। এ্যাপোলো আর ড্যাফনে…একটা ঝাঁকুনি লাগলো মাথায়। রূপান্তর। এইভাবে ভাবা হয়নি। ড্যাফনের লরেল গাছ হওয়া কি এক পাগল প্রেমিকের থেকে পালানোর জন্যে ? নাকি এ্যাপোলো আসলে ড্যাফনেরই ছায়া? তার থেকে পালানোই কাম্য? “রক্ত, আমার রক্ত ঝরে শিউলি গাছর আঠার মত…” এটাই জৈবিক নিয়ম, তাই? এই টার্মটা পড়ানো টা সহজ হবেনা। নিজেকেই কটাক্ষ করলো পরমা, “নারী-পুরুষ” হওয়ার পাঠ নাও হে শিক্ষক, নিজেকে শিক্ষিত করো । দ্বিভাষিক হও!”
এই বয়সে নতুন পাঠ নেওয়া যায় কিনা ভাবতে হবে। মা বলতো, “যা হয়না নয় বছরে, তা হয়না নব্বই বছরে !” লজ্জা পেতে শেখেনি । কান্না চাপতে শেখেনি । ভুলতেও শেখেনি। “নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ” উহার মর্মার্থও বুঝিয়া উঠা হয় নাই। বরং চরণ টলিলেই প্রাণ পরিপূর্ণ উল্লাসে বর্ষার নদীর ন্যায় ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিয়াছে।
“তোর সঙ্গে প্রেম টা করবো কি করে, বস্ , তুই মেয়ে নাকি !”
নাঃ…এই ১৫৮৬০৩৮ জ্বালাবে বলে মনে হ’চ্ছে ।
***
“উইমেন্স লিটারেচার, সেক্শন ওয়ান। আমি পরমা” । চশমা পরা চোখ দুটো এ্যাটেনডেন্স লিস্ট দেখছে।: “কেভিন …ক্রিস্টোফর…মিরিয়ম…রাশেল…ড্যা…ড্যামিয়েন!”
শেষ সারিতে একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। মুখে হাসির আভাস। হাল্কা হাত তোলা। চশমা পরা চোখও হাসছে, বলছে, “তুমি ড্যমিয়েন, আমি মনে রাখবো !”
“মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট। এ ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস্ অফ্ উওম্যান । ১৭৯২। “My own sex, I hope, will excuse me….” এটা আসলে বিদ্রুপ। আমি এখন তোমাদের এক অদ্ভূত মহিলার গল্প শোনাবো… ‘মেয়েমানুষ’-এর সংজ্ঞা …আঠেরোশ শতক…ফরাসী বিপ্লব…নারীত্ব…প্রবঞ্চনা…হে নারীজাতি, পুরুষ হইয়া ওঠো, তোমার দেহখানি পুরুষজাতির খেলনা সামগ্রী নহে…”
কতবার ভেবেছে পরমা বইটার বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিৎ। প্রতিটি শব্দ বিষ মাখানো ফলা। নির্লজ্জ। নির্মম। প্রতিবছরই পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা করে ওঠে রাগে। আজ অন্যরকম। আজ শেষ সারিতে একজোড়া ছুরির মত চোখ। জরিপ করে চলেছে।
“…হে ভদ্রমহোদয়গণ, আর কতকাল আপনারা…”
শেষ সারিতে একটা হাত ব্যস্ত হয়ে লিখে চলেছে মাঝে মাঝে চোখ বইয়ের পাতায় ছিটকে যাচ্ছে।
“ প্রার্থনা করি, বিদ্যায় বিবেচনায় নারীজাতি ক্রমে ক্রমে পুরুষ হইয়া উঠুক, কামপঙ্ক হইতে হতভাগিনীদের উত্তরণ ঘটুক…”
দশটা পঞ্চাশ। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে টাটকা রোদ ক্লাস রুমে ঢুকে পড়েছে কখন যেন। কফি চাই আর একবার।
—“আজ এই পর্যন্ত”। খাতা বই বন্ধ হওয়ার শব্দ। পরমার চোখ আবার শেষ সারিতে।
ড্যাফনে ওয়াকরের চোখে ঝিলিক। পরমার চোখেও ।
এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।
- Apollo and Daphne. Arno Breker. German 1900-1991. Bas relief.
- Daphne by Ernst Wahliss, Bohemia ca.1900
Prints: Courtesy : Google.
Pingback: আমি, ড্যামিয়েন | Methinks…
Reblogged this on আমার আমি.
“নাকি এ্যাপোলো আসলে ড্যাফনেরই ছায়া?” এভাবে তো কখনও ভাবিনি । “খেলনা না হতে চাওয়া” ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবায় । উপায় এবং প্রতিকার খুঁজি মনে মনে ।
Many myths need retelling ‘differently’!