১৯৬৮,১৯৬৯, ১৯৭০-৭১। খুকুর ইউনিভর্সিটির কাল শেষ। বাঁচা গেছে। যে মেয়ে ব্রেবোর্নে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পায়নি বলে বাসন্তীদেবীতে পড়েছে তার পক্ষে কলেজ স্ট্রীটের পাঠ যত তাড়াতাড়ি চোকে ততই মঙ্গল। পক্ষীমাতারা মিলে ঠিক করেছিলো খুকুর গায়ে আঁচটি লাগতে দেওয়া হবেনা। খুকু পেলবতা, রবীন্দ্রসংগীতে থাকুক। এম এ পাশ করে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে এইটেই যথেষ্ট। কিন্তু খুকুর কি যে মতিভ্রম হলো,জীবনে এই প্রথম সে ঘাড় ব্যাঁকালো। চাকরি যখন নেইই, তখন সে বি এড্ পড়বে। মুদিয়ালী রোডের ওপর বি এড্ কলেজ। ‘উপদ্রুত অঞ্চল’। দিনদুপুরে মাথায় হেলমেট পরা সি. আর. পির ট্রামলাইন ধরে টহল। ঐ যুদ্ধক্ষে্ত্রেই যেতো খুকু। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। খুকু গলির মোড় থেকে দেখতো বারান্দায় ঘাড় অল্প হেলিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছে। খুকুকে মোড়ের মাথায় দেখতে পেলেই আস্তে আস্তে ঘরে চলে আসতেন পূর্ণলক্ষ্মী।
প্রথমে দিদি।শিলাদি। সেজদি। ছোড়দি। খুকু কি হাঁপিয়ে উঠেছিলো? নিজের একটা পৃথিবী চেয়েছিলো নিশ্চয়ই? নাহলে যে পৃথিবীটা সে মোটেই চেনেনা, তাতেই বা সে পা দেবে কেন? অথবা চারপাশের ভাঙনের চিহ্ণ থেকে সে বেহিসেবি হওয়ার রসদ পেয়েছিলো হয়তো। কিছুই বলা যায়না। খুকু বদলে যাচ্ছিলো। খুব কম কথা বলে। কোণায় কোণায় ফেরে। খুব বলিয়ে কইয়ে মেয়ে সে কোনওদিনই নয়। এখন যেন আরও চুপচাপ। পূর্ণলক্ষ্মী ভয়ে ভয়ে থাকেন। তবে সেটাই স্বাভাবিক। এই মেয়েটা বরাবরই তাঁর অচেনা দেশ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে করুণার মত মানুষও বোনের সঙ্গে আজকাল মেপে কথা বলে। ভারি অশান্তি। শিলা এলে গুণগুণ করেন পূর্ণলক্ষ্মী। শিলা খানিক চুপ করে থেকে খুব চাপা গলায় বলে, “খুকুর এবার বিয়ে দাও মা”। একটু চুপ করে যান পূর্ণলক্ষ্মী। তারপর বলেন, “বি এড্ টা শেষ করুক…” আসল কথা মেয়েকে বলতে বাধে তাঁর। রসদ ফুরিয়ে এসেছে; সব সঞ্চয় তলানিতে, জমিজমা সব শেষ। থাকার মধ্যে ওই শেষ বারুইপুরের জমিটুকু। ছেলে মেয়েরা যা দেয়, তাতে সংসার খরচ, লোক লৌকিকতা চলে, কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয় কি?
খুকুর পরীক্ষা এগিয়ে আসে। আর সেই সময়ে আর একটি বিপদ আমদানি হয় লাহিড়ী বাড়িতে। বিপদটির নাম অরুণ সরকার। খুকুর সঙ্গে বি এড পড়ে। একসঙ্গে একতলায় বৈঠকখানার পাশের ঘরেতে দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত পড়াশুনো করে দুজনে। দরজা খোলা থাকে আগাগোড়া, তাও কারুর মনে শা্ন্তি নেই। অরুণের বাড়ি শিবপুরে। খুব গরীব বাড়ির ছেলে। বাবার একটা ছোট সব্জীর দোকান, স্কুলে পড়ার সময় বাবার পাশে বসে সব্জী বিক্রি করতো অরুণ। ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ না পেলে পড়াই হতনা তার। এম্এস সি পাশ করে বি এড্ পড়ছে স্কুলের চাকরি তাড়াতাড়ি হয় বলে। তাছাড়া, অরুণ গ্রামে ফিরতে চায়। বরানগরে কাকার বাড়ি থেকে পড়াশুনো করছে কিন্তু সে বাড়িতে পড়ার জায়গা বড় কম,তাই…
এই ছেলেটি আর লাহিড়ী বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে কোথায় একটা অদৃশ্য সংঘর্ষ আছে। শুধু অরুণের বেলায় বিকেলবেলা থালায় করে লুচি তরকারি আসেনা। চা আসেনা। কিন্তু খুকুর তাতে কিছু যায় আসেনা। পাখির মত হালকা পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনতলায় গিয়ে দুকাপ চা করে নিয়ে আসে। বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে মুখার্জী স্যুইটস থেকে জলখাবার আনিয়ে অরুণকে খেতে দেয়। দুপুর বেলা করুণা শক্ত গলায় ডাকেন, “খুকু, খেতে এসো। আমি বসে আছি”। খুকু ততোধিক নরম গলায় জবাব দেয়, “তুমি খেয়ে নাও। আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতে বলো”।
এই রোগা কালো ছোটখাটো চেহারার ছেলেটিকে ঘিরে লাহিড়ী বড়িতে একটা বিপ্লব ঘটতেই পারতো। একটা মধ্যবিত্ত উপন্যাসে সেরকমই হতো সেইসময়ে। যেন “প্রথম কদম ফুল”। বিশেষতঃ খুকু যখন তনুজার মত করেই চুল বাঁধে আর আঁটসাঁট করে শাড়ি পরে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটে ওঠেনা। পরীক্ষার ঠিক আগেই বলা নেই কওয়া নেই অরুন আসা যওয়া বন্ধ করে দেয়। পরীক্ষার হলেও তাকে দেখতে পায়নি খুকু। অরুণ হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলো সবাই। তারপর হঠাৎই খুকুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।
সব রূপকথাই ঠিক নিটোল হয়না। উপাদান গুলো থাকে ঠিকই, কি্ন্তু গাঁথনি গুলো একটু নড়ে নড়ে যায়। ঠিক খুকুর বিয়ের গল্পর মত: সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে উড়ে আসা এক ছেলে দরজায় এসে পড়ে আচমকা। পূর্ণলক্ষ্মী বুঝতেই পারেননা তিনি স্বপ্ন দেখছেন না জেগে আছেন। কিন্তু ঘুমটা ভেঙে যায় খুব তাড়াতাড়ি। গল্পর মধ্যে কোথায় উড়ে এসে জুড়ে বসেন পাত্রর বাবা। এই শিক্ষাটুকুই হতে বাকি ছিলো সাত মেয়ের মা’র। যে মানুষটি আপ্লুত হয়ে বিয়ের কথা পাকা করে তবে চা জলখাবারে হাত দেন, সেই মানুষই পরেরদিন ফোনে এক লম্বা ফিরিস্তি ধরিয়ে দেন পূর্ণলক্ষ্মীর হাতে। যদিও তিনি বার্মায় বহুদিন প্র্যাকটিস করেছেন, তবুও প্রায় রাতারাতি চলে আসার ফলে প্রায় কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। সবে মাত্র বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন প্রচুর খরচা পাতি করে আরও চারটি আছে…মিসেস লাহিড়ী নিশ্চয়ই বুঝবেন, হাজার হোক তিনিও তো চারটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন…আর বাবলুও তো সত্যি বলত কি খুব ‘ordinary’ ছেলে নয়, তিনি যা চাইছেন তা কোনওমতেই বেশী বলে ধরা যেতে পরেনা, তাছাড়া নিজের মেয়েকে তো সবাই যথাসাধ্য সাজিয়ে দেয়… …ইত্যাদি ইত্যাদি…
খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন সাত মেয়ের মা। তারপর করুণাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি করবো বলো ?” কোনও উত্তর দেয়নি করুণা, আস্তে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলো। এই প্রথম। পূর্ণলক্ষ্মীর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো? নাহলে কি করে ভাবলেন এ কথাটা! পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় প্রথম তিন জামাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি: “আমি ভাবছি বাড়িটা বন্ধক দেবো খুকুর বিয়ের জন্যে। আমার তো আর কিছু নেই । ভাবলাম তোমাদের জানাই। তোমরা তো আমার ছেলের মতই”। ছেলের মত। কিন্তু ছেলে তো নয়? তাই খানিকটা সময় লেগেছিলো তিনজনের মুখ খুলতে। দুজন বলেছিলো, “আমরা আছি”। একজন বলেছিলো “যে বিয়ে দিতে হলে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, তেমন বিয়ে নাই বা দিলেন? আপনার মেয়ে তো শিক্ষিত”!
খুকুর শ্বশুর সেই আমলে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা নগদ চেয়েছিলেন। সঙ্গে আর সব আনুসঙ্গিক। করুণার প্রভিডেন্ট ফান্ড উজাড় হয়ে গিয়েছিলো। অন্য মেয়েরা মার সামনে খুলে ধরেছিলো তাদের গয়নার বাক্স। ছেলেরাও দিয়েছিলো যথাসাধ্য। খুকু যে কেন একবারও মাকে বলেনি “এ বিয়ে আমি করবো না” কে জানে। গোল বেধেছিলো বিয়ের ঠিক চার দিন আগে। দুপুরবেলা নাগাদ একটা ফোন পেয়েছিলেন পূর্ণলক্ষ্মী: “নমস্কার। আমার নাম প্রদোষ রায়। আপনার ছোট মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। একটু আগে আমি সব জানতে পেরেছি। শুনুন, আপনি আমার বাবাকে কিছু দেবেন না। আমি বিক্রী হওয়ার জন্যে বিয়ে করছিনা… আর মেয়েকেও অতিরিক্ত শাড়ি গয়না একদম না। বিদেশে ওসব ব্যবহারের সুযোগ হবে না।”। পূর্ণলক্ষ্মী সে কথা পুরো মানতে পারেননি। “ও মা বলিস কি, ব্রাহ্মণের দান ফিরিয়ে নিয়ে মহাপাতকী হবো নাকি!”। বরপণটি বজায় রইলো। এবং বলাই বাহুল্য, এই দানটির কথা ব্রাহ্মণের ছেলেকে জানানো হলোনা। তবে হ্যাঁ, পূর্ণলক্ষ্মী দেবী কি আর অত বোকা? দানসামগ্রী অনেক কাটছাঁট হয়েছিলো। তার মধ্যে ছিলো খুকুর পাঁচ ননদের জন্যে পাঁচজোড়া বালা গড়ানোর নগদ টাকা। এটা বরপণের অতিরিক্ত।
খুব সামান্য আয়োজনে বিয়ে হয়েছিলো খুকুর। মেয়েরা গয়নার বাক্স খুলে দিয়েছিলো বলেই যে মা উজাড় করে নিয়েছিলেন তা নয়। তবে সব দিদিদেরই এক-দুখানা করে গয়না পরে বিয়ে হয়েছিলো খুকুর। পূর্ণলক্ষ্মী, কে জানে কেন, ছোটমেয়েকে একটা সম্পূর্ণ অধিকন্তু ফাঁদি নথ গড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তোর টানা দেওয়া। হয়তো তাঁর নিজের বিয়ের সাজ মনে পড়ে গিয়েছিলো হঠাৎ, কিছুই বলা যায়না …খুকুর শাশুড়ী আড়ালে বলেছিলেন, “পুরোনো প্যাটার্নের গয়না সব…কোথায় একটা মুক্তোর নেকলেস দেবে, তা না মান্ধাতার আমলের ফাঁদি নথ!” খুকুর সবচেয়ে ছোট, ফ্রক-পরা ননদ খুকুকে বলেছিলো: “বৌদি, তোমরা নাকি আগে খুব বড়লোক ছিলে, এখন খুব গরীব হয়ে গেছো?”
খুকুর যাত্রার সময় পূর্ণলক্ষ্মী নিজের ঘরে বসেছিলেন বীরেন্দ্রনাথের সেই আরাম কেদারায়। শিলা নিচে নামেনি। বরান্দা থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় পূর্ণলক্ষ্মীকে বলেছিলো, “মা খুকু চলে যাচ্ছে…” এমন নয় যে মা সঙ্গে সঙ্গে বরান্দায় ছুটেছিলেন। অনেক সাবেকি পরিবারেই ছেলেমেয়ের বিয়ে মা দেখেনা, দেখতে নেই বলে। নাকি নজর লাগে। আর মেয়ের বিদায় তো নৈব নৈব চ…যাত্রাকালে মায়ের চোখের জল ঝরলে ভয়ানক অমঙ্গল। তবে হ্যাঁ, মায়ের বরণডালা আর অধিবাস সাজানোর অধিকার ছিলো। তার জন্যে মায়ের শাঁখা-সিঁদুর থাকতে হয়, পূর্ণলক্ষ্মী আবার সেটাও খুইয়েছিলেন কিনা। গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে গেলে থানের কোণ দিয়ে চোখটা একবার মুছে নিয়ে বলেছিলেন, “ওনার সব ফেলে রেখে যাওয়া কাজ আজ শেষ করলাম। শেষের দিকে খালি জিগেস করতেন. ‘পারবে তো ?’… কাজ তো শেষ হলো, উনি দেখতে পাচ্ছেন কিনা কে জানে’ ”। পাশের টেবিলে ফুলের মালা গলায় বীরেন্দ্রনাথ প্রাণ খুলে হাসছিলেন।
খুকু চলে গিয়েছিলো বহুদূরে, পেনসিলভেনিয়ায়। তারপর এ্যালাবামায়। মাকে পিক্চার পোস্টকার্ড পাঠাতো খুকু। পূর্ণলক্ষ্মী তাকিয়ার তলায় রাখতেন আর মাঝে মাঝে বার করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেন। খুকু কখনো শীতের বরফ কখনো হেমন্তের রং, প্রবাসীদের দূর্গাপূজো এইসব নিয়ে ‘অবাক করে দেওয়া’ চিঠি লিখতো মাকে নীল খামে। শরীরের যত্ন নিতে বলতো। প্রথম শীতে পূর্ণলক্ষ্মী খুকুকে লিখেছিলেন,“তোমাদের ওখানে ব্র্যান্ডি পাওয়া যায়না? রোজ সন্ধ্যেবেলা গরম দুধে মিশিয়ে খাবে। কোকোতেও খেতে পারো; প্রদোষকেও দিও। শীতের দেশে ওসব খেতে দোষ নেই। তোমাদের মা-ছোট তোমার দুই মামাকে নিজে হাতে দিতেন। ওতে শরীর গরম রাখে”। খুকুর ছেলেকে দেখে গিয়েছিলেন পূর্ণলক্ষ্মী। কিন্তু কোলে পিঠে আর করতে পারেন নি। বড় দেরি করে ফেলেছিলো এই নাতিটা।
****
এবার রূপকথায় ফিরতে হয়। ওই যে বলেছিলাম, গাঁথুনি কখনো কখনো নড়ে যায়? নব্বইয়ের মাঝামাঝি সোনা যখন ছোটমাসির কাছে বেড়াতে যায়, পিছনের বাগানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ জিগেস করে বসেছিলো, “আচ্ছা ছোটমাসি, তুমি অরুণমামার কোনও খবর পেয়েছিলে?”। অঞ্জনা জবাব দিয়েছিলেন. “না রে…অনেক চেষ্টা করেছি কেউ বলতে পারেনি। ওই সময়ের গোলমালে অরুণটা হারিয়ে গেলো…”
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
প্রচ্ছদ: AbanindranathTagore Face: http://www.indianartcollectors.com/view-details.php?arid=28959
Pingback: পূর্ণলক্ষ্মীর একাল সেকাল (চতুর্বিংশতি পর্ব ) | Methinks…